ছাত্রলীগ বঙ্গবন্ধুকে অপমান করছে "কোকোর দুর্নীতি ৪৮ ঘণ্টায় ফাঁস করবো"
খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে কোকোর বিরুদ্ধে জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে বিভিন্ন অপরাধে দেওয়া দণ্ডের তথ্য ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ফাঁস করে দেবেন গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন।
মঙ্গলবার বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে গণফোরাম আয়োজিত এক মানববন্ধনে এ কথা বলেছেন তিনি। এছাড়া ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগ বঙ্গবন্ধুকে অপমান করছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
ড. কামাল বলেন, “কেবল বাংলাদেশে নয়, জার্মানি ও আমেরিকার আদালতে কোকোকে বিভিন্ন অপরাধে দণ্ডিত করা হয়েছে। সরকারের উচিৎ এ বিষয়টি বিটিভির মাধ্যমে জনসমক্ষে প্রকাশ করা। আর যদি সরকার তা না করে, তাহলে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আমিই প্রকাশ করবো। হাওয়া ভবন আবার ফিরে আসুক, আমরা এটা চাই না।”
মানববন্ধনে ড. কামাল আরো বলেন, “অতীত ভুলে গেলে জাতিকে চরম মূল্য দিতে হয়। হাওয়া ভবনের কথা ভুলে গেলে চলবে না। এ ভবন থেকে যে পরিমান দুর্নীতি হয়েছে ভবিষ্যতে আর সে সুযোগ দেওয়া যাবে না।”
বাংলাদেশের সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ড. কামাল হোসেন ছাত্রলীগের কঠোর সমালোচনা করে বলেন, “ছাত্রলীগ ধাপে ধাপে বঙ্গবন্ধুকে অপমান করছে। একই সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী এ সংগঠনের তথাকথিত নেতারা মুক্তিযুদ্ধের সব শহীদদেরও সম্মানহানী করেছে। বঙ্গবন্ধুর প্রতি এমন অপমান সহ্য করতে পারি না।”
হলমার্কের অর্থ কেলেঙ্কারি প্রসঙ্গে ড. কামাল বলেন, “বছর শেষে দেশকে ৪০ হাজার কোটি টাকা ঋণ শোধ করতে হয়। এমন পরিস্থিতে একটি প্রতিষ্ঠানকেই ৪হাজার কোটি টাকা দেওয়া মানে দেশের দশ ভাগের এক ভাগ ঋণ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর চাইতে বড় দুর্নীতি আর কী হতে পারে? অচিরেই এর সঙ্গে জড়িতদের বের করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।”
মানববন্ধনে গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টু সম্প্রতি দেওয়া অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যের সূত্র টেনে বলেন, “পালাবার আগে জনগণের কাছে জানিয়ে যাবেন, কেন পালাবেন। দেশের মানুষকে সংকটের মধ্যে ফেলে রেখে আপনারা পালিয়ে যাবেন, আর দেশের মানুষ বসে বসে সেটা দেখবে, তা হতে পারে না।”
হলমার্ক কেলেঙ্কারি, সংসদ ও বিচার বিভাগ দ্বন্দ্ব, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং ফের বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে মঙ্গলবার এ মানববন্ধনের আয়োজন করে গণফোরাম।
মানববন্ধনে বক্তারা সরকারের সব উপদেষ্টাকে দুর্নীতিবাজ আখ্যায়িত করে বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টাও দুর্নীতির দায় থেকে মুক্ত নন। তাদের বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ উঠছে। প্রথমে সব উপদেষ্টা বেশ কথা বললেও যখনই দুর্নীতির অভিযোগ আসছে, তখনই তারা মিডিয়া ও সাংবাদিক থেকে আড়ালে চলে গেলেন। এই হলো উপদেষ্টাদের অবস্থা।”
গণফোরামের মানবন্ধনে আরও বক্তব্য রাখেন- দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কমান্ডার আব্দুর রউফ, যুগ্মসম্পাদক সগির আনোয়ার, আ হ ম সফিউল্লাহ, কেন্দ্রীয় কোষাধ্যক্ষ জামাল উদ্দিন, কেন্দ্রীয় সদস্য জাহানারা বেগম প্রমুখ।
কোকোর বিরুদ্ধে অভিযোগ
প্রধান বিরোধী দল বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর বিরুদ্ধ অর্থ আত্মসাত, সম্পদের তথ্য গোপন, বিদেশে অর্থ পাচারের গুরুতর অভিযোগ রয়েছে।
জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যাংকের একটি যৌথ প্রকাশনায় কোকোর কয়েক লাখ ডলার আত্মসাতের প্রসঙ্গ স্থান পায়। জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধবিষয়ক দপ্তর (ইউএনওডিসি) এবং বিশ্বব্যাংকের সমন্বিত উদ্যোগ: স্টোলেন অ্যাসেট রিকভারি ইনিশিয়েটিভ এর প্রস্তুত করা একটি পুস্তিকায় সিমেন্স কোম্পানির কাছ থেকে কোকোর ঘুষ নেওয়ার অভিযোগকে `জাতীয় মুদ্রা সরানোর` উদাহরণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
`অ্যাসেট রিকভারি হ্যান্ডবুক: অ্যা গাইড ফর প্র্যাকটিশনার্স` নামের পুস্তিকাটি ২০১০ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভিয়েনায় প্রকাশ করা হয়।
পুস্তিকার ১৭৯ পৃষ্ঠায় বলা হয়, বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ছেলেকে ঘুষ হিসেবে বিদেশি একটি কম্পানির দেওয়া অর্থ ২০০৯ সালে বাজেয়াপ্ত করার পদক্ষেপ নেয় যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ। সেসময় যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগের যুক্তি ছিল, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আমেরিকান মূদ্রার বিনিময় কাজটি কেবল যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থরক্ষাকারী ব্যাংকের মাধ্যমেই হতে পারে। ঘুষ দেওয়া প্রতিষ্ঠানটি (সিমেন্স) বিদেশি হলেও সেটি নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে নিবন্ধিত, আর তাই প্রতিষ্ঠানটি যুক্তরাষ্ট্রের আইনের ঊর্ধ্বে নয়।
এর আগে গণমাধ্যমের রিপোর্টে বলা হয়, ২০০৯ সালের ৮ জানুয়ারি মার্কিন কর্তৃপক্ষ ৩০ লাখ মার্কিন ডলারের অর্থ পুনরুদ্ধারে ডিস্ট্রিক্ট অব কলাম্বিয়ার একটি আদালতে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণে উদ্যোগী হয়। কোকো এই অর্থ সিমেন্স থেকে গ্রহণ করেন এবং সিঙ্গাপুরভিত্তিক একটি ব্যাংকে জমা রাখেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
ঢাকার বিশেষ জজ আদালত ২০১০ সালের ৩০ নভেম্বর কোকো ও সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী আকবর হোসেনের ছেলে ইসমাইল হোসেন সাইমনের বিরুদ্ধে অর্থ পাচার মামলায় অভিযোগ গঠন করেন।
এর কয়েক দিনের মধ্যেই জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যাংকের পুস্তিকাটি প্রকাশিত হয়।
কোকো ও সাইমনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে ৯ লাখ ৩২ হাজার ৬৭২ ডলার ও সিঙ্গাপুরে ২৮ লাখ ৮৪ হাজার ৬০৪ ডলার পাচারের অভিযোগ এনে দুর্নীতি দমন কমিশন (এসিসি) ২০০৯ সালের ১৭ মার্চ রাজধানীর কাফরুল থানায় একটি মামলা দায়ের করে।
২০০৭-২০০৮ সালের সেনা সমর্থিত অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে বাংলাদেশ থেকে অর্থ সরিয়ে নেয়ার বিষয়টি ফাঁস হয়। ওই সময় কর্মকর্তারা জানান, তাদের অনুমান প্রভাবশালী কিন্তু দুর্নীতিগ্রস্ত লোকেরা বিদেশে কোটি কোটি ডলার পাচার করেছে। ওই সময় দুর্নীতিগ্রস্তরা ১২ কোটি ৯০ লাখ ডলার দেশে ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হয়।
একই সময় বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রফুল সি. প্যাটেল বলেছিলেন, গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের বিপুল পরিমান সম্পদ দেশের বাইরে পাচার হয়েছে।
এর পরিপ্রেক্ষিতেই কোকোর অর্থ আত্মসাত ও পাচারের বিষয়টিও ধরা পড়ে। এবং দুদকের মামলায় কোকোকে গ্রেফতার করা হয়।
ছাত্রলীগের বেপরোয়া কর্মকাণ্ড
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পরই সারা দেশে বেপরোয়া হয়ে ওঠে ছাত্রলীগ। তাদের দাপটে বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অন্য ছাত্র সংগঠন ক্যাম্পাস ছাড়তে বাধ্য হয়।
কিন্তু অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে নিজেরাই মারামারি করে ক্যাম্পাস অচল করে দেয় তারা। টেন্ডারবাজি, হল দখল বা আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রপের নেতা-কর্মীকে নির্মমভাবে হত্যা করতেও দ্বিধা করেনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ‘ধারক’ ছাত্রলীগ।
তাদের বেপরোয়া কর্মকাণ্ডের কিছু ফিরিস্তি নিচে তুলে ধরা হল -
২০১২ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা-কর্মীরা যখন ঢাকায় বর্ণাঢ্য মিছিল করছেন, তখন সাতক্ষীরা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়ে একনৃত্যশিল্পীর শ্লীলতাহানি ও ধর্ষণের চেষ্টা করে।
এসময় নৃত্যশিল্পীর স্বামীকে অন্য ঘরে আটকে রাখে এবং পরে মোবাইল ফোন রেখে তাড়িয়ে দেয়।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার কয়েক মাসের মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ শাখার সাধারণ সম্পাদক আবুল কালামকে দোতলা থেকে ফেলে হত্যা করে তারই প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপ।
প্রতিদ্বন্দ্বীর হামলায় বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জে নিহত হন ছাত্রলীগ নেতা পলাশ জমাদ্দার।
২০১০ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপের চারজন কর্মীকে তিনতলা থেকে ফেলে দেওয়া হয় যাদের একজন পরে মারা যান।
ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ হয়ে একবার স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর সাংগঠনিক প্রধান বা অভিভাবকের পদ থেকে ইস্তফা দেন।
২০১২ সালের ৮ জানুয়ারি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ৩৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছাত্রলীগ কর্মী জুবায়ের আহমেদকে পিটিয়ে হত্যা করে তার ভ্রাতৃপ্রতীম সহকর্মীরা।
মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর এক বছরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ২০ থেকে ২৫ বার নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী মারামারিতে জড়িয়েছেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্যও কাজ করতে পারেননি ছাত্রলীগের অসহযোগিতার কারণে। চুয়েট বন্ধ হয়েছে ছাত্রলীগের আন্দোলনের কারণে। কুয়েটের ঘটনায়ও ছাত্রলীগ জড়িত।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ছয় মাসে ১৯ বার সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে ছাত্রলীগ। অন্যদের ওপর চড়াও হয়েছে অন্তত ১০ বার।
২০১০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এফ রহমান হলে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের গোলাগুলির শিকার হয়ে জীবন হারিয়েছেন মেধাবী ছাত্র ও খেতমজুর বাবার সন্তান আবু বকর।
0 comments:
Post a Comment